|| তাসনিমুল হাসান ||
The future belongs to those who believe in the beauty of their dreams – Eleanor Roosevelt .
মানুষ প্রতিনিয়ত স্বপ্ন দেখে যায় – কেউ নিজের জীবনের সফলতার ভিত্তি স্থাপন করে আর কেউ নিজের চিন্তাধারার ব্যাপকতা দ্বারা সমাজের প্রতি দায়িত্বের হাত বাড়িয়ে দেয় । তবে প্রতিক্ষেত্রেই নিজের দেখা সে স্বপ্নের গভীরতাই তাকে অনুপ্রাণিত করে তোলে তার কর্মক্ষেত্রে নেওয়া প্রতিটি উদ্যোগে । নিজের দেখা স্বপ্নকে কেন্দ্র করে মানসিক স্বাস্থ্য উন্নয়নে এগিয়ে এসেছেন যেই তরুণ আজ এমনই একজন ব্যক্তি নিয়ে আমার লেখা ।
Rescue এর প্রতিষ্ঠাতা আহমেদ হাবীব – বর্তমানে আইডিয়াল স্কুল এন্ড কলেজের এসএসসি ব্যাচ ২০২১ এর বিজ্ঞান বিভাগে অধ্যয়নরত একজন শিক্ষার্থী । তার প্রতিষ্ঠিত Rescue বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নয়নে নিবেদিত একটি স্টার্ট আপ সংস্থা । স্বাস্থ্যসেবা , তথ্য সেবা ও ঔষধ পত্র মানুষের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দিতে সংকল্পবদ্ধ তার এই সংস্থা ।
তরুণ-তরুণীদের মানসিক স্বাস্থ্য বিকাশের লক্ষ্যে Rescue এর আওতাধীন একটি প্রজেক্ট হলো ” আমরা শুনবো ” । আহমেদ হাবীব এ সম্পর্কে বলেন , ” আমাদের এই প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য সমাজের মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক কুসংস্কার ও অন্ধ বিশ্বাসের বিমোচন করা । মানসিক স্বাস্থ্য খাতের যথাযথ বিকাশ না থাকায় বর্তমানে আমাদের এই প্রজেক্ট এর মাধ্যমে আমরা যুগান্তকারী পরিবর্তন আনতে চাই । “
Gleen Close এর একটি কথা মনে পড়ে যায় ,
” What mental health needs is more sunlight , more candor &
more unshamed conversation ” – ঠিক একইভাবে আহমেদ ও বলেন , ” সকলের না বলা এবং পুঁষে রাখা কথাগুলো শোনা এবং তাদেরকে যৎসামান্য পরামর্শ দিয়ে ভালো বোধ করাতে চাই। এভাবেই, ধীরে ধীরে সমাজের মানসিক সমস্যা সংক্রান্ত ভ্রান্ত ধারণার শিকল আমরা ভেঙে ফেলতে ঐক্যবদ্ধ যেন আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে আমরা একটি উদ্বেগমুক্ত সমাজ উপহার দিতে পারি।” মানসিক স্বাস্থ্য যে শারীরিক স্বাস্থ্যের মতোই গুরুত্বপূর্ণ তা বোঝানোর মধ্য দিয়েই সকল ভ্রান্ত ধারণা দূর করার মাধ্যমে তরুণ-তরুণীদের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়াই ” আমরা শুনবো ” প্রোজেক্টের প্রধান উদ্দেশ্য ।
তবে আমাদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল ” আমরা শুনবো ” এই প্রোজেক্টের পথচলার সূচনালগ্ন নিয়ে । জিজ্ঞেস করতেই আহমেদ হাবীব নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে আমাদের জানান , ” আমাদের আশেপাশের মানুষগুলো মানসিকভাবে অনেক বাজে অবস্থায় রয়েছে এবং আমি নিজেও ব্যাক্তিগত কিছু কারণে এমন মানসিক অসুস্থতার সম্মুক্ষীণ হয়েছিলাম – আমার বন্ধুরা ছাড়া তখন কেও পাশে ছিল না যারা আমাকে শান্তনা দিবে বা সাহায্য করবে। সমাজের তরুন-তরুনীরাও প্রতিনিয়ত নিজের কথাগুলো বলতে না পেরে নিজের মধ্যে চাপিয়ে রাখে যা তাদের মানসিক স্বাস্থ্যে অনেক খারাপ প্রভাব ফেলে – আত্মহত্যাকেও মূল পথ বেছে নেয় অনেকে। মূলত এই সমস্যাগুলোর কথা ভেবে Rescue টিম নিয়ে ২১ এপ্রিল,২০২১ এ “আমরা শুনবো”-এর পথচলা শুরু। “
আর যে কোন প্রতিষ্ঠানের মতোই যাত্রা পথে নানান প্রতিকূলতা – প্রতিবন্ধকতারও মুখোমুখি হয়েছেন তিনি । তবে সকলের সাধারণ কি সমস্যা তারা দেখেছেন এবং সমাধানে কিরকম রেসপন্স পেয়েছেন এর প্রেক্ষিতে তিনি বলেন ” যেহেতু আমরা মানসিক স্বাস্থ্যের মত সেনসেটিভ ব্যাপার নিয়ে কাজ করছি তাই সাহায্য চাওয়া প্রত্যেকটি মানুষের নিরাপত্তা এবং প্রাইভেসি রক্ষা করা বাধ্যতামূলক – এভাবে আগানোর ফলেই আমরা ভালো রেসপন্স পেয়েছি। অনেক ধরনের কেস এসেছে তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে লনলিনেস অর্থাৎ একাকীত্ব বোধ করাকে একটি সাধারণ সমস্যা হিসেবে লক্ষ করেছি যা আমাদের সমাজের অনেক তরুন-তরুনীদের মধ্যে একটি কমন ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে “।
আমাদের দেশে প্রকৃত মেন্টাল হেলথ সম্পর্কিত সংস্থা সম্পর্কেও কিন্তু তিনি বেশ সচেতন । তার মতে , ” বাংলাদেশে প্রকৃত মেন্টাল হেল্থ নিয়ে অনলাইন প্ল্যাটফর্ম রয়েছে, কিন্তু সেটি আকারে খুবই সীমিত । মূল কারণ হচ্ছে আমরা মানসিক স্বাস্থ্যকে শারীরিক স্বাস্থ্যের মতো প্রাধান্য দেইনা। যদি প্রাধান্য দিতাম তাহলে প্রকৃত মেন্টাল হেল্থ নিয়ে অনলাইন প্ল্যাটফর্ম অনেকগুলোই থাকতো। “
অন্যান্য অরগানাইজেশন থেকে তাদের সংস্থাই বা কেন এগিয়ে আছে এ ব্যাপারে কিন্তু আহমেদ হাবীব পরিষ্কার জানিয়ে দেন , ” আমাদের কন্টেন্ট টিম অসাধারণ। প্রত্যেকটি কন্টেন্ট ইউনিক এবং অতুলনীয় ডিজাইন। আমাদের পরিকল্পনাটি দীর্ঘমেয়াদি এবং আমাদের ভলান্টিয়াররা যে কোনো কাজে যথেষ্ট দক্ষ। আমরা এ পর্যন্ত ৫০টিরও বেশি কেস সমাধান করেছি এবং প্রত্যেক কেস সমাধানের পরই পেয়েছি ইতিবাচক মন্তব্য। “
তবে সোশ্যাল মিডিয়ার এই যুগে আমাদের সমাজে যোগ্যের চেয়ে প্রাধান্য পেয়ে যায় অযোগ্যরাই । তাই যখন এ ব্যাপারে তার কাছে জানতে চাই তিনি মতামত দেন “এই যুগে প্রায় সবাই সোশ্যাল মিডিয়া প্রেসেন্স বাড়ানোর লক্ষে প্রতিনিয়ত কাজ করছে। সমাজের প্রায় সবাই পজিটিভ থেকে নেগিটিভে ফোকাস করতে বেশি পছন্দ করে । এরকম দৃষ্টিকোণের কারণেই মূলত বর্তমানে সোশ্যাল মিডিয়াতে যোগ্যের চেয়ে অযোগ্য ব্যক্তি বেশি এটেনশন পাচ্ছে। ” তাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি সুস্থ পরিবেশ বজায় রাখতে কি প্রয়োজন এ ব্যাপারে তিনি মনে করেন ” পেজের ফলোয়াররা যেন সবসময় সেরা আতিথেয়তা পায় , আমাদের কোনো পোস্ট , কমেন্ট বা মেসেজ যেন ফলোয়ারদের উপর নেতিবাচক প্রভাব না ফেলে , সকল কন্টেন্ট যেন কোনো না কোনো ভাবে সবার উপকারিতায় আসে সেই বিষয়টি সবসময় গুরুত্ব দিয়ে দেখা উচিত । “
বর্তমানে Rescue এর “আমরা শুনবো” প্রজেক্ট সঠিকভাবে পরিচালনা করতে ১২জন প্যানেল মেম্বারসহ ৬৩জন ভলান্টিয়ার সবাইকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য নিয়মিতভাবে কাজ করে যাচ্ছে । আহমেদ হাবীব বলেন , ” ছোট ছোট পায়ে আমাদের মূল লক্ষের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি আমরা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশের ১৪% তরুন-তরুনীদেরা মানসিক সমস্যায় ভুগছে যার মধ্যে ৯৪.৫% ই কোন সাহায্য পাচ্ছেনা । আমাদের আশেপাশে তাকালেই এই গুরুতর পরিস্থিতি দেখতে পাই আমরা । ”
নিজের প্রতিষ্ঠিত এই সংস্থা নিয়ে তাই তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে জানান , ” আগামী ৫ বছরের মধ্যে আমাদের এমন একটি জায়গায় দেখতে চাই যেখানে মানসিক স্বাস্থ্যকে সবাই গুরুত্ব দেয় এবং পরবর্তী প্রজন্মকে যেন একটি উদ্বেগমুক্ত সমাজ উপহার দিতে পারি। আমাদের ডেডিকেটেড এবং পরিশ্রমী প্যানেল মেম্বার এবং ভলান্টিয়ারদের জন্যই আমরা বর্তমানে এই পর্যায়ে এসেছি । তাই সত্যি বলতে Rescue টিম নিয়ে আমি খুবই গর্বিত । টাকা-পয়সার বিনিময়ে নয়, আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে একটি উদ্বেগমুক্ত সমাজ উপহার দিতে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সর্বোচ্চ দিয়ে যাচ্ছি আমরা। মাত্র তো পথচলা শুরু, আমরা আমাদের ডেডিকেশন এবং পরিশ্রম দিয়ে মূল লক্ষ্যে পৌঁছাবই ইনশাআল্লাহ। “
আমাদের ব্যক্তিগত জীবনের অভিজ্ঞতাই কখনো কখনো হয়ে দাঁড়ায় স্বপ্ন দেখে নতুন উদ্যোগ নেয়ার মূলমন্ত্র । নিজের দেখা সেই স্বপ্নের বৈচিত্র্যতাকে ভিত্তি করে শুরু করা কর্মজগতের প্রতিটি ধাপকে সফলতার এক অনন্য মাত্রায় নিয়ে যায় আমাদেরই অক্লান্ত পরিশ্রম । ঠিক একইভাবে আহমেদ হাবীব ও স্বপ্ন দেখেছিলেন সমাজের জন্য কাজ করার । ” আমরা শুনবো ” প্রোজেক্টের মাধ্যমে মানসিক স্বাস্থ্য বিকাশের লক্ষ্য পূরণের পাশাপাশি যেন হয়ে উঠেন এরকমই স্বপ্ন দেখা হাজারো তরুনের রোল মডেল – সফলতার দ্যুতি ছড়িয়ে তিনি এগিয়ে যান দৃঢ়প্রত্যয়ে এই শুভকামনা নিয়েই শেষ করছি আজ ।