বিয়ে মানে দুটি মনের অটুট বন্ধন। কখনও বিয়ে করব না- এই কথা বলা মেয়েটাও এক সময় বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে যায় মনের মতো কাউকে পেলে। আর তারপর খুঁজে পায় জীবনের নতুন মানে। মনে অনেক অনিশ্চয়তা আর সংশয় নিয়ে নতুন সংসারে পা রাখে একটি মেয়ে৷ তবে কখনও না দেখা একজন নতুন মানুষের হাত ধরে নতুন করে জীবনের মানে খুঁজে পাওয়ার গল্পগুলোও হয় অভাবনীয়। এমনই এক রূপকথার নায়ক-নায়িকাকে নিয়ে আজকের গল্প।
গল্পটি ইঞ্জিনিয়ার শেখ জান্নাতুল ফেরদৌস নির্ঝর এবং ডা. আহাদ নাজমুল হাসানের। গল্পের শুরুতে চিনতেন না কেউ কাউকে। শুধু একজনের সম্পর্কে জেনে তার প্রেমে পড়ে যাওয়ার মতো ঘটনা বিরল। সপ্তর্শি নামের এক বান্ধবীর মাধ্যমে জান্নাতুল ফেরদৌস নির্ঝরের কথা জানেন ডা. আহাদ। মনে মনে স্থির করে নেন নির্ঝরের সাথেই বাঁধবেন বিয়ের গাঁটছড়া। সেই ভাবনা থেকেই নির্ঝরের বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব পাঠান নাজমুল হাসান৷
ছোটোবেলা থেকে ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্ন ছিল নাজমুলের, কিন্তু বাবা মায়ের ইচ্ছায় মেডিক্যালের পথে হাঁটার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। কিন্তু মনের কোণে ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্ন কোথাও ঠিকই লুকিয়ে ছিল তার। তাই সিদ্ধান্ত নেন ইঞ্জিনিয়ার মেয়ে বিয়ে করার। নির্ঝরের সম্পর্কে প্রথম জানার পর যেন তিনি অনুভব করেন, তিনি যেমন ভাবতেন, ঠিক তেমনই কারোর খোঁজ এবার বুঝি পেলেন!
এদিকে নির্ঝরের বাড়ির লোকেরা অবাক হয় আহাদের কাণ্ড দেখে। কাউকে না দেখে শুধু বর্ণনা শুনে যে কেউ কাউকে জীবনসঙ্গী করার কথা ভাবতে পারে, এমনটি যেন তাদের বিশ্বাসই হয় না। তবুও আহাদ হাল ছেড়ে দেন না। ক্রমাগত ১ মাস ২ দিন চেষ্টায় তিনি নির্ঝরের বাড়ির লোকজনদের রাজি করাতে সক্ষম হন। নির্ঝরের বাড়ির লোকেরা যতই বলেন যে, বিয়ের আগে সামনাসামনি দেখে নিতে। কিন্ত আহাদ তার সিদ্ধান্তে অটল। এমন দৃঢ় মনের কারো কাছে মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত না নিয়ে পারে না নির্ঝরের পরিবার।
বিয়ের যখন সবকিছু ঠিকঠাক, তখন আসে নতুন বিপত্তি। আহাদ ঠিক করে নেন বিয়ের দেনমোহর হবে ঠিক এক কোটি টাকা। এর এক টাকাও কম কিংবা বেশি নয়। এই নিয়ে কেউ কিছু বললে তিনি নাকি দুই কোটি টাকা দেনমোহর ছাড়া বিয়ে করবেনই না। ভালোবাসার এমন উদ্ভট প্রকাশে দুই পরিবারের সবাই অবাক হয়। কিন্তু আহাদের ভালোবাসার কাছে সব ঝামেলা ঠুনকো হয়ে যায়। ২১ ডিসেম্বর, ২০২০ আহাদ আর নির্ঝরের আক্দ সম্পন্ন হয় সুষ্ঠুভাবে।
আহাদকে যখন জিজ্ঞাসা করা হয়, একজনকে না দেখেই কীভাবে ভালোবেসে ফেললেন- এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানান, নির্ঝরের গল্প শুনেই আমার মনে হয়েছে, সে-ই আমার যোগ্য সহধর্মিণী যাকে আমি এতদিন খুঁজে বেড়িয়েছি। তাই আর দেরি করিনি তাকে আপন করে নিতে।
বিয়ে নিয়ে সবার মনেই থাকে নানান স্বপ্ন। অনেক বাধা এসেছিল মাঝপথে, তবুও সব বাধা পেরিয়ে তারা স্বপ্ন পূরণ করেন৷ কোভিড-পরবর্তী সময়ে ধুমধাম করে বিয়ের অনুষ্ঠান হয় তাদের। অক্টোবরের ১, ৩ আর ৫ তারিখে ক্রমান্বয়ে অনুষ্ঠিত হয় ব্রাইডাল শাওয়ার, মেহেদি আর হলুদ।
ব্যাপক আড়ম্বরতায় বিয়ের মূল অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয় ৭ অক্টোবর, ২০২১, সেনা মালঞ্চে।
নির্ঝর এ-সময় বলেন, বিয়ের দিন আমার মেকআপ আর্টিস্ট যিনি ছিলেন, তার মেয়ের করোনা পজিটিভ ছিল, তাই অনেকেই ভয় পেয়ে যায়। এমনকি বউভাতের ডেট চেঞ্জ করে অক্টোবর ৯ থেকে পিছিয়ে, অক্টোবর ১৮ করা হয়। তবে সৃষ্টিকর্তার কৃপায় কেউই কোভিড আক্রান্ত হয়নি, আইসিসিবি হ্যারিটেজ সেন্টারে সবাইকে নিয়ে সুষ্ঠুভাবে রিসিপশন অনুষ্ঠিত হয়। জমকালো অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নিজেদের বিশেষ দিনটিকে আরও বিশেষ করে তোলেন তারা৷ এমনকি রেডিসন ব্লু ঢাকা গার্ডেন-কে তারা পছন্দ করেন তাদের বাসর কাটানোর জন্যে।
দু-জন অচেনা মানুষ এভাবে একে অপরকে না দেখে ভালোবেসে বিয়ে করে নেওয়ার ঘটনা বেশ বিরল। কথায় বলে, ”জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে – এই তিন বিধাতা নিয়ে।” আহাদ- নির্ঝর দম্পতির বেলা এই সত্যিই বুঝি প্রকাশ পেয়েছে৷ বিধাতাই তাদের একীভূত হওয়ার গল্প লিখে রেখেছিলেন বলেই বোধহয় আজ তারা একই সুতোয় বাঁধা।